সন্মিলিত মুনাজাত অস্বীকারকারীগণের অভিযোগ ও জবাব



সন্মিলিত মুনাজাত অস্বীকারকারীগণের অভিযোগ ও জবাব

অভিযোগ-১  
বর্ণিত হাদীসমূহ সম্পর্কে ফরয নামাযের পর মুনাজাত ভিত্তিহীন হওয়ার দাবীদারগণ আপত্তি তুলেন যে, ‘এ হাদীসমূহের কোন একটিতেও ফরয নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত করার কথা উল্লেখ নেই। কেননা, এগুলোর কোনটিতে শুধু দু’আর কথা আছে, কিন্তু হাত তোলার কথা নেই। আবার কোনটিতে শুধু হাত তোলার কথা আছে, কিন্তু তা একাকীভাবে, সম্মিলিতভাবে নয়। আবার কোনটিতে সম্মিলিত মুনাজাতের কথা আছে; কিন্তু ফরয নামাযের পরে হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। অতএব, এ হাদীসসমূহ দ্বারা প্রচলিত সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণিত হয় না!!

জওয়াব - ১  
তাদের অভিযোগের ভিত্তিই সহীহ নয়। কারণ শরীয়তে এমন কোন বিধান নেই যে, প্রত্যেকটা ইবাদতের সকল অংশ কোন একটা আয়াত বা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। নতুবা তা অগ্রহণযোগ্য হবে। তাদের এ আপত্তির জবাবে হযরত মাওলানা মুফতী কিফায়াতুল্লাহ (রহঃ) মুফতী আজম হিন্দুস্তান “কিফায়াতুল মুফতী” গ্রন্থে বলেন- “বিষয়গুলো যেমন কোন এক হাদীসে একত্রিতভাবে উল্লেখিত হয়নি, তেমনি কোন হাদীসে তা নিষিদ্ধও হয়নি। কোন জিনিসের উল্লেখ না থাকার দ্বারা তা নিষিদ্ধ হওয়া বুঝায় না। সুতরাং এ কথা বলা যাবে না যে, এ সব হাদীস নামাযের পরের দু’আর জন্য প্রযোজ্য নয় বরং উল্লেখিত হাদীসমূহের বর্ণনা ভাব এমন ব্যাপকতা সম্পন্ন, যা সম্ভাব্য সকল অবস্থাকেই শামিল করে। তা ছাড়া বিভিন্ন রিওয়ায়াতে এ অবস্থাগুলোর পৃথক পৃথক উল্লেখ রয়েছে-যার সমষ্টিগত সামগ্রিক দৃষ্টিকোণে ফরজ নামাযের পর হস্ত উত্তোলন পূর্বক সম্মিলিত মুনাজাত অনায়াসে ছাবিত হয়। এটা তেমনি, যেমন নামাযের বিস্তারিত নিয়ম, আযানের সুন্নত নিয়ম, উযূর সুন্নাত তরীকা ইত্যাদি একত্রে কোন হাদীসে বর্ণিত নেই। বিভিন্ন হাদীসের সমষ্টিতে তা ছাবিত হয়” তারপরেও তা সকল উলামাদের নিকট গ্রহণযোগ্য।
(দেখুনঃ কিফায়াতুল মুফতী, ৩:৩০০ পৃঃ)


অভিযোগ-২

নামাযের পর মুনাজাতের স্বপক্ষে হাদীসমূহ কেবল নফল নামাযের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এর দ্বারা ফরয নামাযের পর মুনাজাত মুস্তাহাব হওয়া প্রমাণিত হয় না।

জওয়াব-২

বর্ণিত হাদীসসমূহের কয়েকটিতে ফরয নামাযের কথা উল্লেখ আছে। আর কয়েকটির মধ্যে “প্রত্যেক নামাযের পর” কথাটির উল্লেখ আছে। যার মধ্যে ফরয ও নফল সবই শামিল। সুতরাং এ প্রশ্নই অবান্তর। তাদের এ প্রশ্নের জওয়াবে হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, “নামাযের পর মুনাজাত করার পক্ষের হাদীসগুলোর ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ নফল এবং ফরয উভয় নামাযকেই শামিল করেছেন।”
(ফাইযুল বারী, ৪:৪৭ পৃঃ)

মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী (রহঃ) বলেন, “ফরজ নামাযের পর মুনাজাত নফল নামাযের অপেক্ষা উত্তম।”
(ই’লাউস সুনান, ৩ঃ১৬৭ পৃঃ)

সুতরাং কিছুক্ষনের জন্য যদি মেনে নেয়া হয় যে, উক্ত হাদীসসমূহে নফল নামাযের পর মুনাজাত করতে বলা হয়েছে তাহলে উক্ত কথার দ্বারা ফরজ নামাযের পর মুনাজাত আরো উত্তমভাবে প্রমাণিত হবে। এ কারণে যে, নফল নামাযের পর দুআ কবূল হওয়ার কোন ঘোষণা করা হয় নাই, আর ফরয নামাযের পর দুআ কবূল হওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। তো যে ক্ষেত্রে কবুল হওয়ার ঘোষণা নেই, সে ক্ষেত্রে যদি দু’আ ও মুনাজাত করতে হয় তাহলে যেখানে দু’আ কবুল হওয়ার ঘোষণা আছে সেখানে অবশ্যই দু’আ করা কর্তব্য। সুতরাং উক্ত অভিযোগ দ্বারা ফরয নামাযের পরে মুনাজাতকে অস্বীকার করা যায় না।

অভিযোগ-৩

মুনাজাত মুস্তাহাব হয়ে থাকলে, প্রচুর হাদীসে এ ব্যাপারে রাসূল (সাঃ) হতে আমল ছাবিত থাকতো। অথচ এ ব্যাপারে একটি আমলী রিওয়ায়াতও ছাবিত নেই
 

জওয়াব-৩

প্রথমতঃ মুনাজাতের ব্যাপারে ‘রাসূল (সাঃ)-এর আমল সম্পর্কিত একটি রিওয়ায়াতও ছাবিত নেই’-এ কথাটি সম্পূর্ণ গলদ। কারণ এ প্রসঙ্গে অনেকগুলো স্পষ্ট রিওয়ায়াত দ্বারা আমরা রাসূল (সাঃ)-এর আমল অধ্যায়ে রাসূল (সাঃ)-এর মুনাজাত করার হাদীস বর্ণনা করেছি। দ্বিতীয়তঃ মুস্তাহাব আমল প্রমাণের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর কওলী বা মৌখিক হাদীস যথেষ্ট, নবী কারীম (সাঃ)-এর আমল এর মাধ্যমে ছাবিত হওয়া মোটেই জরুরী নয়। কারণ-বহু মুস্তাহাব আমল এমন রয়েছে, যা রাসূলে পাক (সাঃ) বিশেষ হিকমতের কারণে বা সুযোগের অভাবে নিজে করতেন না, কিন্তু সে সবের প্রতি মৌখিকভাবে উম্মতদেরকে উৎসাহ দিতেন। যাতে উম্মত তা আমল করে নিতে পারে। যেমন তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায, চাশতের নামায, আযান দেয়া যাকে আফজালুল আ’মাল বলা হয়ে থাকে ইত্যাদি। এগুলো রাসূলে পাক (সাঃ) থেকে আমল করার মাধ্যমে ছাবিত নেই। অথচ তিনি এসব নেক কাজসমূহের প্রতি উম্মতকে মৌখিকভাবে যথেষ্ট উৎসাহিত করে গিয়েছেন। সকল উলামায়ে কেরাম এগুলোকে মুস্তাহাব আমল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তদ্রুপ মুনাজাতের ব্যাপারে রাসূলে করীম (সাঃ) হতে আমলী রিওয়ায়াত স্বল্প বর্ণিত হলেও মৌখিক রিওয়ায়াত প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। অতএব, মুস্তাহাব প্রমাণ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।

হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী (রহঃ) বলেন, যারা বলে থাকেন যে, মুস্তাহাব প্রমান হওয়ার জন্য রাসূলে পাক (সাঃ)-এর মৌখিক বর্ণনার পাশাপাশি আমলও থাকতে হবে, তারা সঠিক সরল পথ থেকে দূরে সরে পড়েছেন এবং একটি ফাসিদ ও গলদ জিনিসের উপর ভিত্তি করে কথা বলেছেন।
(দ্রষ্টব্যঃ ফাইযুল বারী, ২ঃ৪৩১ পৃঃ)
 

অভিযোগ-৪

মুনাজাতের স্বপক্ষে যে সকল হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া হয়, তার অনেকটাই জ’য়ীফ। অতএব, তা গ্রহণযোগ্য নয়।
 

জওয়াব-৪

এ অধ্যায়ের অনেক সহীহ হাদীসের পাশাপাশি কিছু হাদীস জ’য়ীফ থাকলেও যেহেতু তার সমর্থনে অনেক সহীহ রিওয়ায়াত বিদ্যমান রয়েছে, অতএব, তা নির্ভরযোগ্যই বিবেচিত হবে। দ্বিতীয়তঃ সেই হাদীসসমূহ ফজীলত সম্পর্কে। আর ফজীলতের ব্যাপারে জ’য়ীফ হাদীসও গ্রহণযোগ্য।

(দেখুনঃ আল আযকার লিন নববী পৃঃ ৭-৮, তাদরীবুর রাভী লিস সুয়ূতী পৃঃ ১৯৬, কিতাবুল মাউযূআত লি মুল্লা আলী ক্বারী পৃঃ ৭৩)
 

অভিযোগ-৫

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি ফরজ নামাযের পর যখন সালাম ফিরাতেন, তখন এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়তেন যে, মনে হতো-তিনি যেন উত্তপ্ত পাথরের ওপর উপবিষ্ট ছিলেন। (উমদাতুল কারী, ৬:১৩৯ পৃঃ) এতে বুঝা যায়, হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সালাম ফিরিয়ে মুনাজাত না করেই দাঁড়িয়ে যেতেন।
 

জওয়াব-৫

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর উল্লেখিত আমলের এ অর্থ নয় যে, তিনি সালাম ফিরানোর পর মাসনুন দু’আ-যিকর না করেই দাঁড়িয়ে যেতেন। কেননা-তিনি রাসূলে পাক (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ কখনও করতে পারেন না। রাসূলে পাক (সাঃ) হতে সালাম ফিরানোর পর দু’আ যিকর এর কথা প্রচুর হাদীসে বর্ণিত আছে। সুতরাং রিওয়ায়াতটির সঠিক মর্ম হল-হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) সালাম ফিরানোর পর সংক্ষিপ্ত দু’আ-যিকর পাঠের অধিক সময় বসে থাকতেন না।

অতএব, উল্লেখিত রিওয়ায়াত দ্বারা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর মুনাজাত করা ব্যতীত উঠে পড়া প্রমাণিত হয় না।(আল আবওয়াব ওয়াত তারাজিম, ৯৭ পৃঃ)
 

তাম্বীহঃ


যারা ফরজ নামাযের পরে সর্বাবস্থায় ইজতিমায়ী মুনাজাতের বিরোধী, তারা হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর আমলের ভুল অজুহাত দেখিয়ে সালাম ফিরানোর পর দেরী না করেই সুন্নত ইত্যাদির জন্য উঠে পড়েন। অথচ এর দ্বারা নামাযের পর যে মাসনূন দু’আ ইত্যাদি রয়েছে, তা তরক করা হয়। দ্বিতীয়তঃ ফরজ ও সুন্নাতের মাঝখানে কিছু সময়ের ব্যবধান করার যে হুকুম হাদীস শরীফে পাওয়া যায়, তাও লংঘন করা হয়। তাদের জন্য নিমোক্ত হাদীসটি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্যঃ হাদীসঃ

আবু রিমছা (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদা আমি নবী কারীম (সাঃ)-এর সাথে নামায পড়তে ছিলাম। হযরত আবু বকর ও উমর (রাঃ) ঐ নামাযে উপস্থিত ছিলেন। তারা প্রথম সারিতে নবী কারীম (সাঃ)-এর ডান পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের সাথে এক ব্যক্তি ছিল, যে উক্ত নামাযে তাকবীরে উলা হতেই উপস্থিত ছিল। (অর্থাৎ সে মাসবুক ছিল না) নবী কারীম (সাঃ) নামায শেষ করে সালাম ফিরালেন এমনভাবে যে, উভয় দিকে আমরা তাঁর গন্ডদ্বয় দেখতে পেলাম। অতঃপর নবী কারীম (সাঃ) ঘুরে বসলেন। তখন ঐ তাকবীরে উলায় উপস্থিত ব্যক্তি দাঁড়িয়ে পড়ল সুন্নাত নামায পড়ার জন্য। তৎক্ষণাৎ হযরত উমর (রাঃ) লাফিয়ে উঠলেন এবং ঐ ব্যক্তির উভয় কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন-“বসে পড়! পূর্ববর্তী কিতাবধারীদের (ধর্মীয়) পতন হয়েছে, যখন তারা (ফরজ ও সুন্নাত) নামাযের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করত না।” নবী কারীম (সাঃ) হযরত উমর (রাঃ)-এর এ কাজ দেখে দৃষ্টি উঠালেন এবং বললেন, “হে খাত্তাবের পুত্র! আল্লাহ তোমাকে সঠিক পন্থী বানিয়েছেন।”
(আবু দাউদ শরীফ হাঃ নং ১০০৫)


Post a Comment

0 Comments